
রাতারগুল জলাবন সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি মিঠাপানির জলাবন। একসময় বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন হিসেবে মনে করা হতো রাতারগুলকে।[১][২][৩] তবে পরবর্তীতে জুগিরকান্দি মায়াবন, বুজির বন ও লক্ষ্মী বাওড় জলাবন নামে আরও জলাবন বাংলাদেশে খুঁজ মিলে।[৪][৫][৬] পৃথিবীতে মিঠাপানির যে ২২টি মাত্র জলাবন আছে, “রাতারগুল জলাবন” তার মধ্যে অন্যতম।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এই জলাবনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর। একে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট হিসাবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এর ৫০৪ একর এলাকাকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়াও ৩১ মে ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশের বন অধিদপ্তর ২০৪.২৫ হেক্টর বনভুমিকে বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসবে ঘোষণা করে। এই এলাকাকে বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা (রাতারগুল) হিসাবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে।[৭][৮][৯][১০]
চিরসবুজ এই বন গোয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত (গোয়াইন নদী সারি গোয়াইন নদীর সাথে মিলিত হয়েছে[১১]) এবং চেঙ্গির খালের সাথে একে সংযুক্ত করেছে। এখানে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ (বৈজ্ঞানিক নাম: Millettia pinnata)। এখানকার গাছপালা বছরে ৪ থেকে ৭ মাস পানির নিচে থাকে। বর্ষাকালে এই বন ২০–৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। বাকি সারা বছর, পানির উচ্চতা ১০ ফুটের মতো থাকে।[১২][১৩][১৪] বর্ষাকালে এই বনে অথৈ জল থাকে চার মাস। তারপর ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়ে-চলা পথ। আর তখন পানির আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বিলগুলোতে। সেখানেই আশ্রয় নেয় জলজ প্রাণীকুল।[৮]
অবস্থান
[সম্পাদনা]
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে, গুয়াইন নদীর দক্ষিণে এই বনের অবস্থান। বনের দক্ষিণ দিকে আবার রয়েছে দুটি হাওর: শিমুল বিল হাওর ও নেওয়া বিল হাওর।[৮] সিলেট শহর থেকে এর দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার।
নামকরণ
[সম্পাদনা]সিলেটের স্থানীয় ভাষায় মুর্তা বা পাটি গাছ "রাতা গাছ" নামে পরিচিত। সেই রাতা গাছের নামানুসারে এ বনের নাম রাতারগুল।[১৫]
জলবায়ু
[সম্পাদনা]সিলেটের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ক্রান্তীয় জলবায়ুর এই বনটিতে প্রতিবছর ভারী বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে । বনের সবচাইতে কাছে অবস্থিত সিলেট আবহাওয়া কেন্দ্রের তথ্যমতে এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪১৬২ মিলিমিটার । জুলাই মাসটি সবচাইতে আর্দ্র যখন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১২৫০ মিলিমিটার, অন্যদিকে বৃষ্টিহীন সবচাইতে শুষ্ক মাসটি হল ডিসেম্বর । মে এবং অক্টোবরে গড় তাপমাত্রা গিয়ে দাঁড়ায় ৩২° সেলসিয়াসে, আবার জানুয়ারিতে এই তাপমাত্রা নেমে আসে ১০-১২° সেলসিয়াসে । ডিসেম্বর মাসে এখানকার আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ প্রায় ৭৪ শতাংশ, যা জুলাই-আগস্টে ৯০ শতাংশেরও বেশি ।[১৬]
উদ্ভিদবৈচিত্র্য
[সম্পাদনা]বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এই মিঠাপানির জলাবনটিতে উদ্ভিদের দু'টো স্তর পরিলক্ষিত হয়। উপরের স্তরটি মূলত বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত যেখানে নিচের স্তরটিতে ঘন পাটিপাতার (মুর্তা) আধিক্য বিদ্যমান । বনের উদ্ভিদের চাঁদোয়া সর্বোচ্চ ১৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত । এছাড়াও অরণ্যের ৮০ শতাংশ এলাকাই উদ্ভিদের আচ্ছাদনে আবৃত । বনের স্বাস্থ্য সন্তোষজনক । এখন পর্যন্ত এখানে সর্বমোট ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে ।[১৬]
এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তিতে বাংলাদেশ বন বিভাগ, বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে।[৮] এছাড়া জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণ গাছ[৭]; আছে পিঠালি, অর্জুন, ছাতিম, গুটিজাম। আছে বট গাছও।[৮]
প্রাণিবৈচিত্র্য
[সম্পাদনা]জলমগ্ন বলে এই বনে সাপের আবাস বেশি, আছে জোঁকও; শুকনো মৌসুমে বেজিও দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে বানর, গুই সাপ; পাখির মধ্যে আছে সাদা বক, দেশি কানিবক, মাছরাঙ্গা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি। শীতকালে রাতারগুলে আসে বালিহাঁসসহ প্রচুর পরিযায়ী পাখি, আসে বিশালাকায় শকুনও। মাছের মধ্যে আছে টেংরা, খলিসা, রিটা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউশ, রুই সহ বিভিন্ন জাত।[৮]
পর্যটন আকর্ষণ
[সম্পাদনা]
জলে নিম্নাংঙ্গ ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনের গাছগুলো দেখতে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এখানে ভিড় করেন পর্যটকগণ। বনের ভিতর ভ্রমণ করতে দরকার হয় নৌকার, তবে সেগুলো হতে হয় ডিঙি নৌকা[৮]— ডিঙিতে চড়ে বনের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায় প্রকৃতির রূপসুধা। তবে বনে ভ্রমণ করতে অনুমতি নিতে হয় রাতারগুল বন বিট অফিস থেকে।
চিত্রশালা
[সম্পাদনা]আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "রাতারগুলকে ছাড়িয়ে জুগিরকান্দি 'মায়াবন'"। সময় নিউজ। ১ অক্টোবর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০২২।
- ↑ "বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন রাতারগুল"। DW.COM। ১৬ জুলাই ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ১০ আগস্ট ২০২২।
- ↑ "জলাবন রাতারগুল"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ১১ আগস্ট ২০১৪। ১০ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১০ আগস্ট ২০২২।
- ↑ "মায়াবন"। প্রথম আলো। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০২২।
- ↑ "সিলেটে নতুন পর্যটন স্পট বুজির বন"। দৈনিক নয়া দিগন্ত। ১৮ আগস্ট ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৮ আগস্ট ২০২২।
- ↑ "লোকচক্ষুর আড়ালে রাতারগুলের চেয়েও বড় ও প্রাচীন জলাবন লক্ষ্মীবাওর"। দৈনিক কালের কণ্ঠ। ৩ ডিসেম্বর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ৮ আগস্ট ২০২২।
- ↑ ক খ পাহাড়বাড়ি শুকতারা, সালেহ সফিক; অন্য কোনোখানে, A টু Z, পৃষ্ঠা ১৩, দৈনিক কালের কণ্ঠ; প্রকাশকাল: ১৬ জুলাই ২০১২। সংগ্রহের তারিখ: ৭ সেপ্টেম্বর ২০১২।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জলের বন রাতারগুল[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], ইশতিয়াক হাসান; স্পটলাইট, দৈনিক কালের কণ্ঠ; প্রকাশকাল: ২৮ আগস্ট ২০১১। সংগ্রহের তারিখ: ৭ সেপ্টেম্বর ২০১২।
- ↑ "বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা"। রক্ষিত এলাকা। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২৮ জুন ২০১৯।
- ↑ রাতারগুল
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২২ মার্চ ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ৪ মে ২০২০।
- ↑ "Ratargul Swamp forest – Bangladesh"। ২৭ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৪ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ৩১ আগস্ট ২০১৭।
- ↑ "Ratargul swamp forest – World Tourism Day"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ "বাংলার আমাজন রাতারগুল"। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স আগস্ট ২০১৬। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স। ১ আগস্ট ২০১৬। পৃ. ৪৭।
{{সংবাদ উদ্ধৃতি}}
:|সংগ্রহের-তারিখ=
এর জন্য|ইউআরএল=
প্রয়োজন (সাহায্য) - ↑ ক খ জুনায়েদ কে চৌধুরী (২০০৪)। Biodiversity of Ratargul Swamp Forest, Sylhet, আইইউসিএন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র কার্যালয় । আইএসবিএন ৯৮৪-৩২-১৯৯৬-৬ ।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
